জামান মৃধা, ডিমলা (নীলফামারী)
নীলফামারীর ডিমলায় আতঙ্ক এখন, ”ভূমি জালিয়াতি চক্র”! জাল দলিল চক্রের ভূমি জালিয়াতির দৌরাত্ম্য বেড়ে গেছে। অভিযোগ উঠেছে তথ্য গোপন করে ইউপি চেয়ারম্যানের কাছ থেকে নেওয়া ওয়ারিশন সনদ ব্যবহার করে চক্রটি তিস্তাচরের ১১ একর কৃষিজমি রেজিস্ট্রি করে নিয়েছে। আর এ কাজে তাদের সাব-রেজিস্ট্রার অফিস থেকে সহযোগিতা করার অভিযোগ উঠেছে। রেজিস্ট্রি করা তিস্তাচরের ওই জমির বর্তমান বাজারমূল্য অন্তত দুই কোটি টাকার উর্ধ্বে।
স্থানীয় বাসিন্দারা বলেন, গত ৫/৬ বছর ধরে ডিমলা উপজেলায় জাল দলিল তৈরির এই প্রতারক চক্রটি সক্রিয় রয়েছে। বিশেষ করে তিস্তা চরাঞ্চলের অন্তত ৫ শতাধিক স্থানীয় বসতি ২০/২৫ জনের এ চক্রের প্রতারণার শিকার হয়েছেন। চক্রটির সঙ্গে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তিরাও জড়িত তাই তারা প্রতিবারই রয়ে যায় ধরাছোঁয়ার বাইরে।
জানা গেছে, উপজেলার ঝুনাগাছ চাপানি ইউনিয়নের ছাতুনামা গ্রামের হাসানুর রহমানসহ স্থানীয় ১০/১৫টি পারিবার ১১ একর ক্রয়ের পাশাপাশি ওয়ারিশ সূত্রে পাওয়া জমি গত ৩৯ বছর যাবত ভোগদখল ও চাষাবাদ করে আসছিল।
কিন্তু গত ৩০ আগস্ট তাদের ভোগদখলে থাকা ওই জমির দখল নিতে জামালপুর থেকে মাহমুদুল্লাহ্ ও শেখ মো. রুহুল আমিন নামের দুইজন ব্যবসায়ী আসেন। জনৈক ব্যক্তিরা বলেন, তারা ডিমলা সদর ইউনিয়নের দক্ষিণ তিতপাড়া গ্রামের ফণীভূষণ চন্দ্র সেন ও জগদীশ চন্দ্র সেনের কাছ থেকে সোলার প্যানেলের সাহায্যে বিদ্যুৎ উৎপাদন কারখানা স্থাপনের জন্য ১১ একর ৫ শতাংশ জমি কিনেছেন তারা।
এ ঘটনায় হাসানুর রহমান বাদী হয়ে নীলফামারী সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আমলী আদালতে মামলা দায়ের করেন।
মামলা সূত্রে জানা গেছে, জমির সর্বশেষ খাতিয়ানের মূল মালিকদের অবিবাহিত অবস্থায় মৃত্যু দেখিয়ে ১৪ জনের একটি ভূমিদস্যু জালিয়াতি চক্র কৌশলে ওয়ারিশন সনদ তৈরি করে। এই চক্রটির কেউ জমির মালিক, আবার কেউ দলিলগ্রহীতা, এছাড়া কেউ দাতা, শনাক্তকারী ও সাক্ষী সেজে জাল আম-মোক্তারনামা দলিল তৈরি করে কৌশলে লিখে নেয় তিস্তা চরের ১১ একর ৫ শতাংশ জমি।
সম্প্রতি সময়ে জমিতে চাষাবাদ করতে গিয়ে স্থানীয় লোকজন জানতে পারেন, তাদের জমি এখন মাহমুদুল্লাহ ও রুহুল আমিনের। এর প্রতিকার চেয়ে ডিমলা উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) অফিসে লিখিত অভিযোগ দেন তারা। ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, জাল দলিল তৈরি করে এভাবে জমি হাতিয়ে নেওয়া সম্ভব হয়েছে ডিমলার সাব-রেজিস্ট্রার কে, এম সুজাউদ্দিন, ঝুনাগাছ চাপানি ইউপি চেয়ারম্যান একরামুল হক চৌধুরী এবং ইউনিয়ন ভূমি সহকারী কর্মকর্তা গোলাম রাব্বানীর সহযোগিতায়।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, ছাতুনামা মৌজার ওই ১১ একর ৫ শতাংশ জমি গত ১ আগস্ট মাহমুদুল্লাহ রহমান ও রুহুল আমিন নামে ডিমলা সাব-রেজিস্ট্রি অফিস থেকে অপ্রত্যাহারযোগ্য আম-মোক্তারনামা দলিল করা হয়েছে। সাব-রেজিস্ট্রি অফিসের দলিল লেখক আব্দুল মান্নানের সম্পাদনায় একটি দলিলের (দলিল নম্বর-২৯৮৩/২৪) মাধ্যমে জমি হস্তান্তর করা হয়। আর আম-মোক্তারনামা দলিলে দুইজনকে বিক্রেতা দেখানো হয়েছে। জমি রেজিস্ট্রি হওয়ার বিষয়টি গত আগস্টের শেষে জানতে পারেন জমির প্রকৃত মালিকগণ।
এদিকে ওয়ারিশন সনদ দাখিলের ছয় দিনের মাথায় কোনো তদন্ত ছাড়াই ৫০টি দাগে ১১ একর ৫ শতাংশ জমির নামজারি অনুমোদন দেন উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) ফারজানা আক্তার ও ইউনিয়ন ভূমি সহকারী কর্মকর্তা গোলাম রব্বানী। যেখানে নামজারি করতে কমপক্ষে ১ মাস সময় লাগার কথা!
মামলার বাদী হাসানুর রহমান জানান, পৈতৃক ও ক্রয়সূত্রে জমির মালিক তারা। জীবিত ব্যক্তিকে মৃত দেখিয়ে মিথ্যা ওয়ারিশ সনদ বের করে তাদের জমি জালিয়াতির মাধ্যমে বিক্রি করা হয়েছে। প্রতিকার চেয়ে বিজ্ঞ আদালতে মামলা করেছি।
খালিশা চাপানি ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান একরামুল হক চৌধুরী অভিযোগ স্বীকার করে বলেছেন, দয়াল চন্দ্রের ওয়ারিশদাররা ভারতে চলে গেছেন। তারা এলাকায় না থাকায় স্থানীয়দের কথায় ফণীভূষণ ও জগদীশ চন্দ্রকে ওয়ারিশন সনদ দিয়েছি। কিন্তু সনদ দিয়ে তারা যে জমি বিক্রি করবে সেটা জানতাম না। এটা হয়তো আমার ভুল হয়েছে।
সাব-রেজিস্ট্রার কে, এম সুজাউদ্দিন অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, প্রয়োজনীয় কাগজপত্র দেখে জমি রেজিস্ট্রি করা হয়েছে। দলিল লেখকের দেওয়া তথ্য যাচাই-বাছাই করে ওই দলিল করা হয়।
এ প্রসঙ্গে সহকারী কমিশনার (ভূমি) ফারজানা আক্তার মাতৃকালীন ছুটিতে থাকায় বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।
ডিমলা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রাসেল মিয়া বলেন, অভিযোগের বিষয়টি জানতে পেরেছি। অধিকতর তদন্ত করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে। এছাড়া বিষয়টি জেনে পদক্ষেপ গ্রহণের আশ্বাস দিয়েছেন জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ নায়িরুজ্জামান।
ইতিপূর্বে ২০২৩ সালের ২২ জুন ডিমলা উপজেলার সাবেক সাব-রেজিষ্ট্রার মনীষা রায়ের যোগসাজশে জাল স্বাক্ষর ও নামজারী দিয়ে তিস্তার চরাঞ্চলে ২ হাজার পরিবারের বসতভিটাসহ ১ হাজার ৩৯ একর জমি জাল দলিল তৈরি করে লিখে নেন, রংপুরের সফিয়ার রহমান ও মেহেদী হাসান নামের দুই ব্যক্তি।
জামান মৃধা-০১৭৩০-৯৮৩৮৯৭