শনিবার, ২৪ মে ২০২৫, ০১:৩৮ পূর্বাহ্ন

বালু খেকোদের দখলে তিস্তা, ঝুঁকির মুখে গ্রাম ও সড়ক

বালু খেকোদের দখলে তিস্তা, ঝুঁকির মুখে গ্রাম ও সড়ক

জামান মৃধা, ডিমলা (নীলফামারী)

উত্তরের জনপথ দেশের সীমান্তবর্তী লালমনিরহাট ও নীলফামারী । দুই জেলায় প্রতি বছর বর্ষা মৌসুমে তিস্তা নদীর ভাঙ্গনে বিলীন হয় শত শত ঘরবাড়ি, বসতভিটা ও আবাদি জমি।

 

নদী ভাঙ্গনরোধে সরকারিভাবে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিলেও কিছু বালুখেকো তিস্তা নদী থেকে অবৈধভাবে বোমা মেশিন দিয়ে বালু উত্তোলন করছেন। শুধু বালু উত্তোলনই নয়! নদী থেকে প্রতিদিন শত শত টলি বালু ট্রাক্টর যোগে বিক্রি করা হচ্ছে। এতে করে লাভবান হচ্ছে বালু খেকোরা আর ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে নদী তীরবর্তী বসবাসরত মানুষজন।

 

দেশে আইন আছে, সেই আইনের যথাযথ প্রয়োগ নাই। তাই আইন লঙ্ঘন করে নীলফামারীর ডিমলা উপজেলার পূর্ব ছাতনাই ইউনিয়নের ঝাড়সিংহেশ্বর, খগাখরিবাড়ী ইউনিয়নের পাগলপাড়া বাজার সংলগ্ন এলাকা, টেপাখরিবাড়ী ইউনিয়নের তিস্তা বাজার, ঝুনাগাছ চাপানি ইউনিয়নের আশ্রয়ন কেন্দ্র ও ভেন্ডাবাড়ী ডনের সাউট সংলগ্ন ১ নং স্পার বাঁধ, নাউতারা ইউনিয়নের শালহাটি বাজার ও সাতজান ডাঙ্গাপাড়া।

এছাড়া ডিমলা সদর ইউনিয়নের নটাবাড়ী এলাকা থেকে প্রতিদিন অবৈধভাবে বালু ও মাটি ট্রাক্টরে করে বিক্রি করা হচ্ছে।

 

অপর দিকে লালমনিরহাটে একটি পাঁচটি উপজেলা থেকে তিস্তার বালু উত্তোলন করছে  প্রভাবশালী কিছু নেতারা।

প্রতিদিন লালমনিরহাটে ৫০ পয়েন্ট দিয়ে টলি করে মাটি বালু উত্তোলন করছে।

হাতীবান্ধা উপজেলার ডাউয়াবাড়ি ইউনিয়নের তিস্তা নদী থেকে প্রতি দিন শত শত টলি বালি নিয়ে বিক্রি করছে। এতে প্রশাসন নিরব।

 

প্রশাসনের যথাযথ নজরদারি না থাকায় স্থানীয় কতিপয় প্রভাবশালী ব্যক্তি অবাধে ওই বালু ও মাটি কেঁটে নিয়ে বিক্রি করছেন। এতে বিস্তীর্ণ নদীর তীরবর্তী এলাকা হুমকির মুখে পড়েছে। বিরূপ প্রভাব পড়ছে জীববৈচিত্র্যে। হুমকিতে ফেলছে সামাজিক পরিবেশ। নষ্ট হচ্ছে ফসলি জমি ও গ্রামীণ সড়ক। তাছাড়া ট্রাক্টর চলাচলের ধূলাবালিতে আক্রান্ত হচ্ছে শ্বাসকষ্ট জনিত রোগে।

 

স্থানীয় লোকজন জানান, নদী তীরবর্তী অন্যান্য স্থাপনারমত উপজেলার পূর্ব ছাতনাই ইউনিয়নের ঝাড়সিংহেশ্বর ও ঝুনাগাছ চাপানি ইউনিয়নের আশ্রয় কেন্দ্র, প্রতিবছর বন্যায় প্রবল ভাঙ্গনের শিকার হয়। ক্ষতিগ্রস্ত হয় কয়েক হাজার পরিবার। এছাড়া ডালিয়া পানি উন্নয়ন বোর্ড ভাঙ্গন কবলিত ওই এলাকায় প্রতিবছর বর্ষা মৌসুমে প্রায় কোটি টাকার জরুরী প্রতিরক্ষামূলক কাজ করে থাকেন। গত কয়েক মাস থেকে এলাকার কয়েকজন প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গ ওই এলাকা থেকে বালু ও মাটি কেঁটে নিয়ে বিক্রি করছে। প্রতিদিন বালু ও মাটি কেঁটে কয়েক শতাধিক (টলি) ট্রাক্টরে তুলে বিভিন্ন স্থানে বিক্রির জন্য পাঠানো হচ্ছে। প্রতি ট্রলি বিক্রি করা হচ্ছে ৮০০-১০০০ টাকায়।

অথচ সরকারি গেজেটে বালুমহাল ও মাটি ব্যবস্থাপনা আইন, ২০১০-এর ৪ নম্বর ধারায় উল্লেখ করা হয়েছে, বিপণনের উদ্দেশ্যে কোনো উন্মুক্ত স্থান, চা-বাগানের ছড়া বা নদীর তলদেশ হতে বালু বা মাটি উত্তোলন করা যাবে না। এ ছাড়াও সেতু, কালভার্ট, ড্যাম, ব্যারেজ, বাঁধ, সড়ক, মহাসড়ক, বন, রেললাইন ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ সরকারি বা বেসরকারি স্থাপনা অথবা আবাসিক এলাকার এক কিলোমিটারের মধ্য থেকে বালু ও মাটি উত্তোলন সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।

গত শনিবার ও রবিবার সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, নদীরতীর, স্পার, গাইড বাঁধের নিকটবর্তী জায়গা, তিস্তা নদীর তলদেশ থেকে বালু ও মাটি তোলা হচ্ছে। এলাকাবাসীর অভিযোগ, গত ৪/৫ মাস থেকে এই সকল জায়গার স্থান থেকে বালু ও মাটি তুলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এলাকার এক ব্যক্তি অভিযোগ করে বলেন, গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা থেকে এভাবে বালু ও মাটি না তোলার জন্য তাঁদের (বালু-মাটি ব্যবসায়ী) নিষেধ করা হয়েছিল। কিন্তু তারা শোনেননি। উল্টো আমাকে হুমকি দিয়েছিলেন। তাই নিজের মান-সম্মান বজায় রেখে চুপ করে থাকি।

স্থানীয় বালু ব্যবসায়ী খলিলুর রহমান ও জুলহাস মিয়া দাবি করেন, একসময় নদীর মধ্যে তাদের জমিজমা ছিল। নদী ভাঙ্গনে এসব জমি নদী গর্ভে বিলীন হয়ে যায়। জমি ভেঙ্গে গেলেও সেখানে শুষ্ক মৌসুমে চর জেগে ওঠে। তাই সেখান থেকে মাটি কেঁটে ও বালু তুলে ব্যবসা করছেন। আইনে এভাবে মাটি ও বালু তোলা যে নিষিদ্ধ, তা তারা জানেন না বলে জানান।

কথা হয় ঝাড়সিহেশ্বর এলাকার ভুক্তভোগী সাইজুদ্দি, মুজিবুর রহমান, কল্পনা আক্তার ও আশ্রয়ণ কেন্দ্রের মোমেনা খাতুন, আব্দুল জব্বার মিয়া, বিলকিস বেগমের সঙ্গে। তবে ভয়ে কেউ বালুখেকোদের নাম মুখে আনলেন না। তাঁদের ভাষ্য, এসবের সঙ্গে জড়িত স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গ ও দুর্ধর্ষ প্রকৃতির লোকজন। প্রতিবাদ করলে আর রক্ষা নেই! তবে ঘটনাস্থলে গিয়েও দেখা মেলেনি এ কাজের সঙ্গে জড়িতদের।

ঝুনাগাছ চাপানি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান একরামুল হক চৌধুরী বলেন, এ বিষয়টি আমি জেনেছি। কিন্তু এখানে আমার কোন কিছু করণীয় নেই। এর পরও আমি তাঁদের নিষেধ করেছি। প্রয়োজনে আরো নিষেধ করবো।

ডালিয়া পওর বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী আসফাউদৌলা (প্রিন্স) বলেন, যারা এসব কর্মকান্ডে জড়িত, তাঁদের তালিকা তৈরি করে ঐ সকল ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

 

উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) ফারজানা আকতার বলেন, অবৈধ বালু উত্তোলন বন্ধ করতে বিভিন্ন এলাকায় অভিযান অব্যাহত রয়েছে। ইতিমধ্যে বেশ কয়েকজনকে জরিমানাও করা হয়েছে।

 

ডিমলা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. নুর-ই-আলম সিদ্দিকী বলেন, নদী ও কৃষি জমি থেকে বালু উত্তোলন অবৈধ। বালু উত্তোলন বন্ধে জড়িতদের বিরুদ্ধে ভ্রাম্যমান আদালতের মাধ্যমে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।

Please Share This Post in Your Social Media

© All rights reserved © 2024 Rangpurtimes24.Com
Developed BY Rafi IT