হাছিন আরজু —
থিসিসের জন্য প্রায় আট থেকে দশটি শিরোনাম লিখে থিসিস তত্বাবধায়কের রুমে হাজির হলাম। তত্বাবধায়ক স্যার সবগুলো শিরোনাম দেখে জিজ্ঞেস করলেন, ” তোমার বাসা কোথায়?” বললাম, ” স্যার, দিনাজপুর।” শুনে স্যার জিজ্ঞেস করলেন, ” সাঁওতালদের উপর কাজ করতে পারবে না? ” প্রতুত্তরে মাথা হেলিয়ে সম্মতি দিলাম ও মনে মনে খুশি হলাম এই ভেবে, আমার একটি ছোট স্বপ্ন বাস্তবে রূপ দান করতে পারব। স্যারের কথামত কাজ পুরোদমে শুরু করলাম।
তথ্য সংগ্রহের সময় লক্ষ্য করলাম, আদিবাসী সাঁওতালদের মধ্যে শিক্ষিত লোক তো দূরের কথা স্বাক্ষর জ্ঞানসম্পন্ন লোকের সংখ্যা অনেক কম। এ অবস্হা দেখে মনের মধ্যে হাজারো প্রশ্ন ঘুরপাক খেতে লাগলো। নিজেকে শৈশব কৈশোরের মধ্যে আবারো খুঁজে পেলাম। নিজেই নিজেকে জিজ্ঞেস করলাম, ” কেন আমার শিক্ষা জীবনে কোন সাঁওতাল সহপাঠী ছিল না? কেন এই মানুষগুলোকে দেখলে আমি ভাবতাম, ওরা শুধু বন্যপশুই শিকার করবে? কেন পাঠ্যবইয়ে কখনো সাঁওতালদের নিয়ে কিছু পড়েছি বলে মনে হয় না?”
এমন অনেক প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে জানতে পারলাম, শিক্ষার জন্য সাঁওতালদের ঘরে বাইরের সংগ্রাম। একদিকে পেটের দায় এড়ানোর জন্য অর্থনৈতিক লড়াই, অন্যদিকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর কর্তা ব্যক্তিদের খামখেয়ালিপনা। সরকারি উপবৃত্তি ও বেসরকারি সাহায্যের অসম বন্টন হচ্ছে। সবার ওপর সুদৃষ্টি পরছে না। বৈষম্যের স্বীকার সাঁওতালরা শিক্ষা অর্জনে নিরুৎসাহিত হচ্ছে। অর্থনৈতিক দুরবস্থার সাথে বৈষম্য মিলেমিশে জটিল অবস্হার সৃষ্টি করছে। অবস্থাদৃষ্টে যেন অধ্যাপক নার্কসের দারিদ্রের দুষ্টুচক্রের অন্যরূপ হয়ে দাঁড়িয়েছে। খুব কম সাঁওতাল এই চক্র থেকে বের হয়ে শিক্ষা অর্জন করতে পারছে।
সাঁওতাল ভাষা ও সংস্কৃতি সাঁওতাল জাতিসত্তার অনন্য বৈশিষ্ট্য। সাঁওতালদের জন্য আলাদা বিদ্যালয় না থাকায় সময় সময় এসবের জন্যেও নির্যাতনের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। অনেক বাঙালি পরিবার সাঁওতালদের নিজস্ব সংস্কৃতি ও জীবনপ্রবাহকে স্বীকার করতে চান না। বাঙালি ছেলেমেয়েরা সাঁওতালদের সাথে পড়ালেখা করবে তা মানতে পারেন না। এজন্যে, নিজের সন্তানকে সাঁওতালদের সাথে মিশতে মানা করে দেন। অন্যদিকে, বিদ্যালয়গুলোতে সাঁওতাল ভাষায় পাঠদান করা হয় না। এ কারনে, শিশুরা পাঠ্য বিষয় বুঝে উঠতে পারেন না।
ফলে, অনেক শিশু পড়াশোনা থেকে ঝরে পরছে। অধিকন্তু, পিছিয়ে পরা জনগোষ্ঠী হিসেবে সাঁওতাল শিশুদের জন্য বিশেষ যত্নের প্রয়োজন। শিক্ষকদের মধ্যে এ ব্যাপারে প্রশিক্ষণ ও দক্ষতা অভাব রয়েছে।
সময়ের সাথে আমাদের দেশ অনেক এগিয়ে যাচ্ছে। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, ” পশ্চাতে রেখেছ যারে সে তোমারে পশ্চাতে টানিছে।” সাওতালদের পশ্চাৎ থেকে সামনে আনতে শিক্ষার কোন বিকল্প নেই। তাই, সাঁওতাল সম্প্রদায় যেন নিজেই নিজেদের হাল ধরতে পারে তার জন্য শিক্ষার ওপর গুরুত্ব বাড়াতে হবে।
আশার কথা হলো, সাঁওতালরা সময়ের সাথে জেগে উঠছে। সন্তানদের পড়াশোনার বিষয়ে সচেতনতা বাড়ছে। এই জনসচেতনতা কাজে লাগাতে দরকার সরকারি বেসরকারী বিশেষ উদ্যোগ যা একটি জাতির ভবিষৎ পরিবর্তন করতে পারে।
লেখক:
হাছিন আরজু
শিক্ষার্থী
সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
মোবাইল: ০১৫১৮৯৮৬৮০৯
জি মেইলঃ hasinur99du@gmail.com