মোস্তাফিজার রহমান, পীরগাছা (রংপুর):
জীবন থেকে ৭৬ বছর পেরিয়ে গেলেও আজো স্থায়ীভাবে কোন মাথা গোজার ঠাঁই হয়নি বৃদ্ধা হামিদা বেগমের।
জীবনের এই পড়ন্ত বিকেলে এসে এখনো অন্যের জমিতে পুরনো কাপড় দিয়ে ঘেরা ছোট একটি ছাপড়া ঘরে খেয়ে না খেয়ে দিন পার করছেন ওই বৃদ্ধা।
হামিদা বেগমের সাথে ৫০ বছর আগে বিয়ে হয়েছিল রংপুরের পীরগাছার জগৎপুর গ্রামের সোলায়মান আলীর। বিয়ের পর থেকেই তিনি দেখেন তার স্বামীর কোন ভিটেমাটি নেই। অন্যের জমিতে মানুষের দয়ায় ছোট ঝুপড়ি ঘরেই চলছিল তাদের সংসার। তবে অন্যের জমিতেও তাদের বেশিদিন ঠাঁই হতোনা। কয়েক বছর পরপর তাদেরকে মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘুরতে হতো একটু আশ্রয়ের জন্য। স্বামী সোলায়মান আলী দিনমজুরি করে কোনমতে সংসার চালাতেন।
সেই স্বামীও ৬ বছর আগে মারা গেছেন। তাদের দীর্ঘ সংসার জীবনে একটি মাত্র সন্তান হামিদ মিয়া (৪০) সেও কিছুটা মানসিক প্রতিবন্ধী। ছেলে বাড়িতে থাকেনা। মসজিদে মসজিদে থেকে বেড়ায়। সেই ছেলের বউ মনোয়ারা বেগম (৩৫) এবং দুই নাতী শামীম (৮) ও শাকিবকে (৬) নিয়ে বৃদ্ধা হামিদা বেগমের বর্তমানে ঠাঁই হয়েছে ভ্যানচালক আনারুল ইসলামের ভিটার এক কোনায়। সেখানে মানুষের সাহায্য নিয়ে কোনমতে ছোট একটি টিনের ছাপড়া ঘর দিতে পারলেও তার বেড়া এখনো পুরোপুরি দিতে পারেননি। উপায় না পেয়ে ঘরের অর্ধেকাংশে ঘেরা দিয়েছেন নিজের পুরনো পড়নের কাপড় দিয়ে। সেই ঘরেই ছোট একটি ভাঙ্গা-চোরা চৌকিতে গাদাগাদি করে ছেলের বউ ও দুই নাতীকে নিয়ে থাকেন বৃদ্ধা হামিদা বেগম। একটু বৃষ্টি হলেই সেই ঘরে ঢুকে পড়ে পানি। বৃদ্ধা হামিদা বেগমের একটি হাত প্যারালাইসিস হয়ে অকেজো হয়ে গেছে। লাঠিতে ভর দিয়ে তিনি চলাফেরা করেন। ছেলের বউ মানুষের বাসায় কাজ করে যা পায় তা দিয়েই কোনমতে চলছে তাদের জীবন।
সরেজমিনে উপজেলার পারুল ইউনিয়ের জগৎপুর গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, একজনের বসতবাড়ির এক কোনায় ছোট একটি টিনের ছাপড়া ঘর। সেই ঘরের অর্ধেক অংশে টিনের বেড়া থাকলেও বাকী অর্ধেক পড়নের কাপড় দিয়ে ঘেরা। নেই দরজা। সেখানে পুরনো একটি চৌকি পাতা। একটি ভাঙ্গা-চোরা টেবিলে রাখা কয়েকটি হাড়ি-পাতিল। একপাশে রাখা কিছু খড়ি ও জিনিসপত্র। সেই ঘরেই থাকছেন ওই বৃদ্ধা তার ছেলের বউ ও নাতীদের নিয়ে। বৃদ্ধা হামিদা বেগমের বয়স এখন ৭৬। একটি হাত অকেজো। বয়সের ভারে কথা বলতে গিয়ে খেই হারিয়ে ফেলেন।
ছেলের বউ মনোয়ারা বেগম বলেন, আমার স্বামী আধাপাগল। সে বাড়িতে থাকে না। বিভিন্ন মসজিদে থাকে। অসুস্থ্য শ^াশুড়ী ও দুই ছেলেকে নিয়ে এই ঘরে এক চৌকিতে গাদাগাদি করে রাত পার করি। বৃষ্টি-বাতাস হলে বৃষ্টির পানি ঢুকে বিছানা ভিজে যায়। তখন সারারাত বসে থেকে রাত কাটাতে হয় আমাদের। আয়-রোজগারের লোক নাই। আমি মানুষের বাসায় কাজ করে যা পাই তা দিয়ে খেয়ে-না খেয়ে কোনমতে দিন পার করছি। কখনো কাজ না থাকলে উপোষ থাকতে হয়। আশেপাশের মানুষ মাঝে মধ্যে আমাদেরকে খাবার দেন। আমাদেরকে স্থায়ী একটি থাকার ঘরের ব্যবস্থা করে দেয়ার জন্য আমি সরকারসহ বিত্তবানদের সাহায্য কামনা করছি।
স্থানীয় স্কুল শিক্ষক আলমগীর প্রামানিক, হারুন মিয়াসহ অনেকে বলেন, আমরা জন্মের পর থেকেই তাদেরকে দেখছি মানুষের জমিতে থাকে। সরকারি আশ্রয়ন প্রকল্পে তাকে যেতে বলা হলেও তিনি স্বামীর গ্রামের মায়া ছেড়ে যেতে চাননা। বর্তমান যুগেও তাদের যে করুণ দশা, তা খুবই দুঃখজনক। আমরা সরকারের কাছে এই গ্রামেই তার জন্য একটি স্থায়ী মাথা গোজার ঠাঁই করে দেয়ার জন্য আমরা দাবী জানাচ্ছি।
ওই ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য নুরুল আমিন বলেন, ওই বৃদ্ধাকে বিধবা ভাতা করে দেয়া হয়েছে। সরকারের আশ্রয়ন প্রকল্পে ঘর ও জমির ব্যবস্থা করে দেয়ার চেষ্টা করা হলেও তিনি এই গ্রাম থেকে যেতে না চাওয়ায় তা আর করা হয়ে ওঠেনি। তবে ঈদের সময় তাকে ভিজিএফ চাল দেয়া হয়।
পারুল ইউপি চেয়ারম্যান তোফাজ্জল হোসেন বলেন, আমি অসুস্থ্য। বিষয়টা আমাকে কেউ জানায় নাই। খোঁজ নিয়ে দেখবো তার জন্য কি করা যায়।
পীরগাছা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ নাজমুল হক সুমন বলেন, ওই পরিবারের পক্ষ থেকে আবেদন করা হলে বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে দেখা হবে।