শনিবার, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০২:২৪ অপরাহ্ন

পেছাচ্ছে না ইলিশ ধরায় নিষেধাজ্ঞার সময়সীমা

পেছাচ্ছে না ইলিশ ধরায় নিষেধাজ্ঞার সময়সীমা

নিউজ ডেস্ক :

উৎপাদন বাড়ানোর লক্ষ্যে প্রজনন মৌসুমে মা ইলিশকে ডিম ছাড়ার সুযোগ দিতে আগামী ১২ অক্টোবর থেকে ২ নভেম্বর পর্যন্ত ২২ দিন সারাদেশে ইলিশ আহরণ, পরিবহন, ক্রয়-বিক্রয়, মজুত ও বিনিময় নিষিদ্ধ। কিন্তু এখনো ইলিশের পেটে ডিম আসেনি দাবি করে নিষেধাজ্ঞার সময়সীমা পিছিয়ে দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন জেলে ও ব্যবসায়ীরা। গবেষণার মাধ্যমে পাওয়া তথ্য বিবেচনায় নিয়েই এ সময়সীমা নির্ধারণ হয়েছে। এ কারণে পেছানোর সুযোগ নেই বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

জানা যায়, সম্প্রতি মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রীর সভাপতিত্বে ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে প্রধান প্রজনন মৌসুমে ইলিশ আহরণ বন্ধের সময় নির্ধারণ এবং মা ইলিশ সংরক্ষণ অভিযান ২০২৩ বাস্তবায়নের জন্য ইলিশ সম্পদ উন্নয়ন সংক্রান্ত জাতীয় টাস্কফোর্স কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, প্রধান প্রজনন মৌসুমে ইলিশের নিরাপদ প্রজননের লক্ষ্যে ১২ অক্টোবর থেকে ২ নভেম্বর (২৭ আশ্বিন থেকে ১৭ কার্তিক ১৪৩০) পর্যন্ত মোট ২২ দিন সারাদেশে ইলিশ আহরণ নিষিদ্ধ থাকবে। এসময় দেশব্যাপী ইলিশ পরিবহন, ক্রয়-বিক্রয়, মজুত এবং বিনিময়ও নিষিদ্ধ থাকবে। একই সঙ্গে মা ইলিশ সংরক্ষণ অভিযান বাস্তবায়ন করা হবে। ইলিশ আহরণ নিষিদ্ধ থাকাকালে ইলিশ আহরণে বিরত থাকা জেলেদের ভিজিএফ-এর আওতায় খাদ্য সহায়তা দেবে সরকার।

সরকারের ঘোষণার পরই ২২ দিনের এ নিষেধাজ্ঞার সময়সীমা পিছিয়ে দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন পটুয়াখালীর বড় মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র মহিপুরের জেলে ও ব্যবসায়ীরা।

সরকারের সব সিদ্ধান্ত মেনে নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে মহিপুর বন্দর আড়ৎ মালিক সমিতির সভাপতি মাসুম ব্যাপারী বলেন, কোনো ইলিশের পেটে এখন পর্যন্ত ডিম আসেনি। ১২ অক্টোবর নিষেধাজ্ঞা শুরু হলে ইলিশ মাছের প্রজনন বৃদ্ধিতে সরকারের নেওয়া পদক্ষেপ ভেস্তে যাবে। তাই ১২ অক্টোবরের পরিবর্তে ৩০ অক্টোবর থেকে নিষেধাজ্ঞার সময়সীমা নির্ধারণের দাবি জানাচ্ছি।

একইভাবে নিষেধাজ্ঞা পেছানোর দাবি জানিয়েছে বরিশাল সদর থানা মৎস্য আড়তদার অ্যাসোসিয়েশন। ২৫ সেপ্টেম্বর সংবাদ সম্মেলনে অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মো. নিরব হোসেন টুটুল বলেন, আগামী ১২ অক্টোবর সরকারের যে নিষেধাজ্ঞা শুরু হচ্ছে তা এক মাস পরে অর্থাৎ আগামী ১২ নভেম্বর থেকে শুরু করার অনুরোধ জানাচ্ছি। তাছাড়া সরকারের ইলিশ রপ্তানি কার্যক্রম চলবে আগামী ৩০ অক্টোবর পর্যন্ত। নিষেধাজ্ঞা থাকলে মাছ রপ্তানিতেও সমস্যা হবে। তাই প্রধানমন্ত্রীর কাছে আকুল আবেদন জানাচ্ছি, সারা দেশের ইলিশ ব্যবসায়ী ও শ্রমিকদের কল্যাণে মা ইলিশ রক্ষা অভিযানের সময়সীমা পিছিয়ে দেওয়ার জন্য।

তবে গবেষণা সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অন্য বছর যেভাবে ইলিশ ধরা বন্ধের সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হয়, এবারও সেভাবেই যে গবেষণা পদ্ধতি আছে, সে নিয়মের মধ্যেই নির্ধারণ হয়েছে। বিগত ৩৪ বছর যেহেতু ঠিকভাবেই এটি হয়েছে, এবারেরটাও সঠিক হবে।

মৎস্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, উৎপাদন বাড়াতে প্রজনন মৌসুমে মা ইলিশকে ডিম ছাড়ার সুযোগ দিতে ২২ দিন সারাদেশে ইলিশ আহরণ, পরিবহন, ক্রয়-বিক্রয়, মজুত ও বিনিময় নিষিদ্ধ করার বিষয়টি অনেক গবেষণার মাধ্যমে সব পক্ষের সঙ্গে আলোচনা করেই নির্ধারণ করা। যেহেতু জেলেরা এর বড় একটি অংশ, তাই তাদের মতামতও গুরুত্ব দেওয়া হয়। সেক্ষেত্রে তাদের সময়সীমা পেছানোর যে দাবি সেটি এ বছর বিবেচনার সুযোগ না থাকলেও আগামী বছর হয়তো সার্বিক পরিস্থিতির আলোকে বিবেচনা করা যেতে পারে।

ইলিশ সম্পদ সংরক্ষণে ‘প্রটেকশন অ্যান্ড কনজারভেশন অব ফিশ অ্যাক্ট, ১৯৫০’ এর অধীন প্রণীত ‘প্রটেকশন অ্যান্ড কনজারভেশন অব ফিশ রুলস, ১৯৮৫’ অনুযায়ী এ ২২ দিন সারাদেশে ইলিশ মাছ আহরণ, পরিবহন, মজুত, বাজারজাতকরণ, ক্রয়-বিক্রয় ও বিনিময় নিষিদ্ধ করেছে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়। এ ২২ দিন এসব কার্যক্রম করলে আইন অমান্যকারী কমপক্ষে এক থেকে সর্বোচ্চ দুই বছর সশ্রম কারাদণ্ড অথবা পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।

বাংলাদেশে ২০০৩-২০০৪ সাল থেকেই জাটকা রক্ষার কর্মসূচি শুরু করা হয়। তখন থেকেই ধীরে ধীরে ইলিশের উৎপাদন বাড়ছে। ২০০৮ সাল থেকে প্রথম আশ্বিন মাসে পূর্ণিমার আগে ও পরে মিলিয়ে ১১ দিন মা-ইলিশ ধরায় নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়। তখন থেকেই এর সুফল দেখতে শুরু করেন বিজ্ঞানীরা। তখন তারা গবেষণায় দেখতে পান, শুধু পূর্ণিমায় নয়, এ সময়ের অমাবস্যাতেও ইলিশ ডিম ছাড়ে।

মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও ইলিশ গবেষক ড. আনিছুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, ইলিশ ধরায় যে নিষেধাজ্ঞার সময়, সেটি পেছানোর দাবি তারা করতেই পারেন। সেক্ষেত্রে যুক্তি থাকতে হবে। যুক্তি কিন্তু মৌখিক যুক্তি নয়, গবেষণাভিত্তিক ও তথ্যভিত্তিক যুক্তি আসতে হবে। তাদের এ ধরনের কোনো তথ্য আছে কি না আমি জানি না। আজ সেপ্টেম্বরের শেষ সময়ের দিকেও ইলিশের পেটে ডিম আসেনি, সেটি ঠিকই আছে। ডিম আসেনি, আসবে। সে কারণেই ওই সময়টাতে অবরোধ দেওয়া হয়েছে, সেটা তো ঠিকই আছে। সে সময়ে পেটে ডিম আসবে না, উনারা কীভাবে জানলেন? ডিম আসবে কি না, সেটি পৃথিবীর কোনো মানুষই বলতে পারে না। পৃথিবীতে যদি ব্যতিক্রম কিছু না হয়, পানির গুণাগুণ ঠিক থাকে তাহলে এ সময়সীমাটাও ঠিক হবে। আর যদি অনেক কিছু পরিবর্তন হয় সেটা তো হতেই পারে। হয়তো একদিন-দুইদিন বা কয়েক ঘণ্টা আগে পরে হতেই পারে। ২২টি দিন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এখন বাজারে বড় ইলিশ পাওয়া যায়, এটি এমনি এমনি হয়নি।

তিনি জানান, প্রথম দিকে প্রস্তাব ছিল এক মাস বন্ধ রাখার, কিন্তু এভাবে বন্ধ রাখলে হয় না। এখন ২২দিন করা হয়েছে, পূর্ণিমার সঙ্গে এখন অমাবস্যা যোগ করা হয়েছে। এখন সেজন্য আগে ও পরে কয়দিন বেশি রাখতে হয়। অক্টোবরে পূর্ণিমা আগে আসুক কিংবা অমাবস্যা আগে আসুক তার দুই দিন আগে থেকে টোটাল ২২দিন ইলিশ ধরা বন্ধ রাখতে হয়। ১৪ অক্টোবর কিন্তু অমাবস্যা। সে কারণেই আগে ১২ ও ১৩ তারিখ হাতে রাখতে হয়েছে। আর ২৯ তারিখে পূর্ণিমা। সেটি হিসাব করেই মোট ২২ দিন করা হয়েছে। তিন বছর পর পর এটি নিয়ে নতুন করে চিন্তা করতে হয়। কিন্তু তাদের (জেলে ও ব্যবসায়ী) দাবি অনুযায়ী করলে নভেম্বর ও ডিসেম্বর শীতকাল। সে সময় নদীতে কি ইলিশ থাকে?

মৎস্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক খ. মাহবুবুল হক জাগো নিউজকে বলেন, আমরা সব স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে আলোচনা করে অন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠক করে এটি নির্ধারণ করেছি। গত বছর যেদিন মা ইলিশ সংরক্ষণ অভিযান শেষ হলো তার একদিন পরেই নদীতে কোনো মাছ নেই। তার মানে আমরা সঠিক জায়গায় ছিলাম। এটি কমবেশি সময় হতে পারে। কিন্তু গবেষণায় দেখা গেছে, আমরা যে সময়টায় করেছি সে সময়টিতে যতটুকু ডিম দেওয়ার সুযোগ পাবে, সেটা আমাদের সমুদ্রের যতটুকু জায়গা, তার জন্য এখন পর্যন্ত যথেষ্ট। এটার প্রমাণ হচ্ছে প্রতিবছর আমাদের উৎপাদন কিন্তু বেড়েছে। তার মানে পদক্ষেপগুলো যথাযথ হচ্ছে। এখন এক জায়গার জন্য এক সময় আবার আরেক জায়গার জন্য আরেক সময়, এটি করা যাবে না। কারণ একই দেশে এটি ভিন্নভাবে করলে সেটির কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকবে না।

Please Share This Post in Your Social Media

© All rights reserved © 2024 Rangpurtimes24.Com
Developed BY Rafi IT