জামান মৃধা, ডিমলা (নীলফামারী)
নীলফামারীর ডিমলা উপজেলার তিস্তার নদীর একাধিক চরাঞ্চল ও বেড়ীবাঁধে আশ্রয় গ্রহণ করা ছিন্নমূল মানুষের মাঝে ঈদের আনন্দ নেই।
দারিদ্রতার করালগ্রাস ও নদীর সঙ্গে সংগ্রাম করে বেঁচে থাকা মানুষগুলোর জীবনে খুশির বার্তা বয়ে আনতে পারেনি এবারের ঈদ। নদী ভাঙ্গন আতঙ্কের মধ্যে দিন কাটছে তাদের।
জানা গেছে, বর্ষা মৌসুমে অতিরিক্ত পানি প্রবাহের ফলে তিস্তা নদীতে ভয়াবহ বন্যার সৃষ্টি হয়। বন্যায় সব থেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় নদী তীরবর্তী চরাঞ্চলের হাজারো মানুষ। তিস্তা নদী জন্মলগ্ন থেকে খনন না করায় প্রতিবছর কোটি কোটি ঘন ফুট পলি পড়ে ভরাট হয়েছে নদীর তলদেশ। ফলে পানি প্রবাহের পথ না পেয়ে বর্ষাকালে উজানের ঢেউয়ে ডিমলা উপজেলার ১৫টি চরগ্রাম ও পার্শ্ববর্তী জলঢাকা উপজেলার নদী তীরবর্তী এলাকায় ভয়াবহ বন্যার সৃষ্টি হয়। এ সময় নদী ভাঙ্গনও বেড়ে যায় কয়েকগুণ। প্রতি বছরই তিস্তা নদী পরিবর্তন করছে তার গতিপথ। বর্ষায় ভয়াবহ বন্যার ধকল কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই ভাঙ্গন আতঙ্কে পড়ে তিস্তাপাড়ের বাসিন্দারা। গেল সপ্তাহে তিস্তায় পানি কমার পরপরই তীব্র ভাঙ্গনের মুখে পড়ে নদীপাড়ের মানুষ। এক একটি পরিবার ৮/১০ বার নদী ভাঙ্গনের শিকার হয়ে সরিয়ে নিয়েছেন তাদের পৈত্রিক বসতভিটা। কেউ কেউ রাস্তার ধারে বা উঁচু বেরীবাঁধের পাশে মানবেতর জীবন যাপন করছেন।
স্থানীয় বাসিন্দারা বলেন, ঘুরে দাঁড়ানোর শত চেষ্টা করেও বারবার নদী ভাঙ্গনে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে পরিবারগুলো। তাই আসছে ঈদের নতুন পোশাক অথবা ভালো খাবার জুটবে না তাদের ভাগ্যে।
সরোজমিনে দেখা গেছে, উপজেলার খগা খড়িবাড়ি ইউনিয়নের নদী ভাঙ্গন কবলিত চর কিসামত গ্রাম। এ গ্রামের শতাধিক পরিবার তিস্তার ভয়াবহ ভাঙ্গনে গৃহহীন হয়ে পড়েছে। যাদের মধ্যে অনেকেই আশ্রয় নিয়েছে উঁচু বেড়ীবাঁধের উপর। এসব পরিবারের কেউ জেলে কেউবা দিনমজুর। বেড়িবাঁধে তাদের আশ্রয় মিললেও মেলেনি না কোন সুযোগ সুবিধা। ঈদে সন্তানদের নতুন পোশাক কিনে দেয়া তো দূরের কথা! তাদের ভাগ্যে ভালো খাবারও জুটবে কি না তাও জানে না তারা।
কিসামত চরের বাসিন্দা মফিজুল ইসলাম (৭০) তার ৪ একর জমি ছিলো। কিন্তু ভাঙ্গনের কবলে সব নদীতে গেছে। এভাবে ১০ বার ভাঙ্গনের পর সর্বস্ব হারিয়ে এখন অন্যের জমিতে আশ্রয় নিয়েছেন। পঁচিশ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে কোন রকম ঘর তুলেছেন। কিন্তু বর্ষায় ঘরে কোমর পানি ওঠে। তিন ছেলে ও প্রতিবন্ধী এক মেয়ে নিয়ে তার সংসার। মফিজুল বলেন, ঈদ এলেও ছেলে-মেয়েদের নতুন জামা কাপড় কিনে দিতে পারিনি। নদীতে মাছ নেই, তাই রোজগারও কম। এদিকে তিস্তার পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় আবার ভাঙ্গন শুরু হয়েছে। দিন কাটছে এক বেলা খেয়ে। আমাদের আবার কিসের ঈদ!
একই অবস্থা পার্শ্ববর্তী বাসিন্দা নুরী বেগমের (৫০)। পনের বছর ধরে পরিবার পরিজনসহ পূর্ব ছাতনাই ইউনিয়নের বেড়িবাঁধের উপর বসবাস করছেন তিনি। স্বামীসহ দুই ছেলে ও দুই মেয়েকে নিয়ে সংসার তার। নদী ভাঙ্গনের ভয়াবহ স্মৃতি এখনও ভূলেননি তিনি। আগামী দিনগুলো তার কাছে অন্ধকারাচ্ছন্ন- কোথায় থাকবেন, কি খাবেন জানা নেই তার।
নুরী বলেন, ছয় বার নদী ভাঙ্গনে সব হারিয়েছি। নতুন করে ঘর তুলতে পারিনি এখনো। আশ্রয় নিয়েছি বেড়িবাঁধের উপর ঝুপড়ি ঘরে। পানি বাড়লেই ভাঙ্গন আতংকে বুক কেঁপে ওঠে। বাচ্চাদের নতুন জামা কিনে দিতে পারিনি। কোন সহযোগিতাও পাইনি।
বেড়ীবাঁধের আরেক বাসিন্দা আন্জুয়ারা বেগম বলেন, সকলেই ঈদ আনন্দ করবে। কিন্তু আমাদের আনন্দ নেই! কবে ভালো করে ঈদ পালন করেছি তাও মনে নেই! গরিবের তো ঈদ নেই। ঘড়দোর তুলতে পারিনি, ঝুপড়ি ঘরে আছি, ঈদের দিন ভালো খাবারও জুটবে না, ডাল ভাত খেয়ে ঈদ কাটাতে হবে।
শুধু নুরী ও আন্জুয়ারা নয়, তিস্তার ভাঙ্গনে সব হারিয়ে বেড়িবাঁধে আশ্রয়ন নিয়েছেন অন্তত দশ হাজার পরিবার। ঈদ আসে ঈদ যায়, কিন্তু কিছুতেই ভাগ্যের পরিবর্তন হয় না। নদীর অব্যাহত ভাঙ্গন ও প্রকৃতিক দুর্যোগে একের পর ক্ষতিগ্রস্ত এসব পরিবার কিছুতেই ঘুরে দাঁড়াতে পারছে না। সেই অবস্থায় ঈদের আনন্দ এই পরিবারগুলি ভুলেই গেছেন।
নীলফামারীর ডালিয়া পাউবো সুত্রে জানা গেছে, উপজেলার কালিগঞ্জ সীমান্ত হতে ভারত-বাংলাদেশ যৌথ বাঁধ ঝুনাগাছ চাপানী পর্যন্ত ৪০ কিঃমিঃ বেড়ীবাঁধ অংশে আশ্রয় নিয়েছে কয়েক হাজার পরিবার। এছাড়া উপজেলার ৬টি ইউনিয়নের সহস্রাধিক পরিবারের বসবাস বাঁধের বাহিরে তিস্তার ১০টি চরগ্রামে। পৈত্রিক বসতভিটা হারা এসব মানুষের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে উপজেলা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ কর্মকর্তা (পিআইও) মেজবাহুর রহমান বলেন, সরকারি ভিজিএফ কর্মসূচীর ১০ কেজি করে চাল দরিদ্রদের মাঝে বিতরণ করা হয়েছে। সেগুলোর তালিকা তৈরি করেছেন জনপ্রতিনিধিরা। এসবের বাহিরে চরগ্রাম এলাকার জন্য আলাদা কোন বরাদ্দ নেই। তারপরেও কেউ যদি সরকারি সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয় তাহলে আমরা তাদের জন্য বিশেষ কর্মসূচী নিতে পারি।