জামান মৃধা, ডিমলা (নীলফামারী)
নীলফামারীর ডিমলায় জাতীয় ভূমি ব্যবহার নীতিমালা লংঘন করে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে নির্বিঘ্নে উর্বর তিন ফসলি কৃষি জমি নষ্ট করে প্রতিযোগিতামূলক পুকুর খননের নামে বালু উত্তোলনের মহোৎসবে মেতে উঠেছে একটি প্রভাবশালী ভূমি মালিক ও স্কেভেটর (ভেকু) মালিক। বিভিন্ন মহল ম্যানেজ করে তিন ফসলি কৃষিজমিতে পুকুর খনন আবার কোথাও পুকুর সংস্কারের নামে বালু উত্তোলনের অভিযোগ উঠেছে।
অথচ বালুমহাল ও মাটি ব্যবস্থাপনা আইন ২০১০-এ বলা হয়েছে, সেতু, কালভার্ট, ড্যাম, ব্যারাজ, বাঁধ, সড়ক, মহাসড়ক, বন, রেললাইন এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ সরকারি ও বেসরকারি স্থাপনার আশপাশ থেকে বিপণনের উদ্দেশ্যে বালু বা মাটি উত্তোলন করা যাবে না। এছাড়াও কৃষি জমি সুরক্ষা ও ব্যবহার আইন-২০১৬ (৪) ১ ধারায় দেশের সকল কৃষি জমি এই আইন দ্বারা সুরক্ষিত হবে। এবং কোন ভাবেই তার ব্যবহার ভিত্তিক শ্রেণী পরিবর্তন করা যাবে না। তবে উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের অনুমোদন সাপেক্ষে কোন বিশেষ ক্ষেত্রে এবং উদ্দেশ্যে প্রণীতবিধি মোতাবেক অত্র বিধানবলী পরিবর্তন করা যাবে।
এই আইন লংঘনকারীর বিরুদ্ধে কৃষি জমি সুরক্ষা ও ব্যবহার আইনের ৪(১), ৪(২) ধারায় কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান অথবা সহায়তাকারীর সর্বোচ্চ ৩ বছর সশ্রম কারাদণ্ড বা ৩ লাখ টাকা জরিমানা অথবা উভয় দন্ডে শান্তির বিধান রয়েছে। গত কয়েকদিনে উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়ন ঘুরে দেখা গেছে, অপরিকল্পিত ভাবে তিন ফসলি কৃষি জমি থেকে মাটি উত্তোলন, পুকুর খনন, পুরাতন পুকুরের তলদেশ থেকে ২০-২৫ ফুট গভীর করে বালু উত্তোলন করছে একটি প্রভাবশালী মহল।
ওই বালু পরিবহনে (ট্রাক্টর) নষ্ট হচ্ছে পিচঢালা পাঁকা সড়ক, গ্রামীণ জনপথ ও তিন ফসলি কৃষি জমি ধ্বংসযজ্ঞ চললেও প্রশাসন যেন কিছুই দেখছে না! প্রতিনিয়ত প্রকাশ্যে কৃষি জমি থেকে অবৈধভাবে মাটি কাঁটার পর তা ট্রাক্টরে পরিবহনের জন্য পিচঢালা ও গ্রামীন সড়ক ব্যবহার করা করায় বালু-মাটি বোঝাই ভারী যানবাহন চলাচল করায় রাস্তা ভেঙ্গে যানবাহন চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়ছে। এবং ওই সড়ক সংস্কারে সরকারের খরচ হচ্ছে কোটি টাকার ঊর্ধ্বে।
এছাড়া সড়কগুলো নষ্ট হওয়ায় ভোগান্তি পোহাচ্ছে এলাকার সর্বস্তরের সর্বসাধারণকে। উপজেলার ঝুনাগাছ চাপানি ইউনিয়নের চৌধুরীপাড়া গ্রামের রাকিবুল হাসান বলেন, বর্তমান সময়ে মাছ চাষ লাভজনক হওয়ায় পুকুর খননে মানুষের মধ্যে আগ্রহ বেড়েছে। ফলে প্রতিযোগিতামূলকভাবে উপজেলার প্রায় প্রতিটি ইউনিয়নে তিন ফসলি আবাদি জমি, বসতভিটার পাশে পুকুর কাঁটার মহোৎসব চলছে। উপজেলার ঝুনাগাছ চাপানি ইউনিয়নের ৪ নং ওয়ার্ড মাস্টার পাড়া গ্রামের লিয়াকত হোসেন আড়াই বিঘা জমিতে নতুন পুকুর খনন করছেন। এই পুকুর খনন বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, বাড়ীর পাশে জমি হওয়ায় ফসল ভালো হয় না। বর্তমান মাছ চাষ লাভজনক হওয়ায় পুকুর খনন করছি। ফসলি জমিতে পুকুর খনন করার জন্য ভূমি অফিস অথবা মৎস্য অফিসের কোন অনুমতি নিয়েছেন কি না? জানতে চাইলে, তিনি বলেন, আমার জমিতে আমি পুকুর করব। কার অনুমতি লাগবে! তবে স্কেভেটর মালিকের (ঠিকাদার) সঙ্গে যোগাযোগ করে কাজ করছি।
কয়েকজন ট্রাক্টরের (টলি) ড্রাইভার মজিদ, মিলন, আলম, শামীম এবং মূল ঠিকাদার স্কেভেটর মালিক আশরাফুল ইসলাম বলেন, বর্তমান এ উপজেলাতে প্রায় ৫-৬টি স্কেভেটর (ভেকু) এবং কয়েক শতাধিক ট্রাক্টর (টলি) চলছে। সবাইকে ম্যানেজ করে আমরা এসব চালাচ্ছি। স্থানীয় অনেকেই অভিযোগ করে বলেন, পার্শ্ববর্তী এলাকার (কলোনি বাজার) ছাইদুর রহমানের ১টি স্কেভেটর (ভেকু) চলছে, সে সহ অন্য স্কেভেটর মালিকেরা উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় পুকুর খননের চুক্তি নেন। তারা প্রতি রাতে ওই পুকুরগুলোর গভীর থেকে বালু উত্তোলনের কথা জানতে চাইলে বলেন, রাতে করে ৮/১০ টলি বালু না তুললে পোষায় না। তাই মাঝে মধ্যে একটু বালু তুলি।
মাটি ও বালুর টলি কত টাকায় বিক্রি হয়? জানতে চাইলে বলেন, মাটি নিকটে ৫০০ থেকে ৭০০ এবং বালু ৯০০ থেকে ১১০০ টাকায় বিক্রি হয়। উপজেলার বালাপাড়া ইউনিয়নের হোসেনের মোড় এলাকার একাধিক ব্যক্তির সাথে কথা বলে জানা যায়, গত কয়েকদিন আগে আনোয়ার হোসেন নামের এক স্কেভেটর মালিক এবং সাহাবুল নামের টলির মালিক ওই এলাকার শফিকুল ইসলামের একটি পুকুর খননের চুক্তি নেন। সে দিনের বেলায় পুকুরের মাটিকাঁটে এবং রাতভর ওই পুকুরের পলিমাটি স্কেভেটর দিয়ে সরিয়ে বালু উত্তোলন করে।
এ বিষয়ে ডিমলা থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) দেবাশীষ কুমার রায় বলেন, সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পাওয়া গেলে অবশ্যই আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
ডিমলা উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) ফারজানা আক্তার বলেন, সরকারি নিয়ম-নীতির বাহিরে পুকুর খননের কোন সুযোগ নাই। পুকুর খননের নামে বাণিজ্যিকভাবে বালু উত্তোলন হলে বিধি মোতাবেক তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ইতিমধ্যে ভ্রাম্যমান আদালতের মাধ্যমে অনেকেই জরিমানা করা হয়েছে। জামান মৃধা, ডিমলা (নীলফামারী) ০১৭৩০-৯৮৩৮৯৭